জীবন বৃত্তান্ত

পরিবারিক পরিচিতি:

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা হায়দার আকবর খান রনো ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইল জেলায় এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান রনো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর ডাক নাম রাখা হয়েছিল রনো। এখন তিনি এই নামেই পরিচিত। পিতৃভূমি নড়াইল জেলার নড়াইল থানার অন্তর্গত চিত্রা নদীর পাড়ে বরশালা গ্রাম (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অন্তর্গত)। নানাবাড়ি নড়াইল থানায় অন্তর্গত মির্জাপুর গ্রাম। নানা ছিলেন ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক সৈয়দ নওশের আলী।

পিতা হাতেম আলী খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ১৯৬৮ সালে মরহুম হাতেম আলী খান তদানিন্তন পূর্ব

হায়দার আকবর খান রনো’র একমাত্র কন্যা রানা সুলতানা। তার দুই নাতি আছে। অরিত্র ও অন্তিক।

শিক্ষাজীবন:

হায়দার আকবর খান রনো ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলজীবনে তিনি বরাবরই ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্টগ্রেগরী স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকাস্থ সেন্টগ্রেগরী স্কুল হতে ম্যট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তিনি মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ হতে আই এস সি পাশ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু পদার্থবিদ্যার কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি কারাবাস ও অন্যান্য কারণে। পরে তিনি কারাগারে অবস্থানকালে আইনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন। কিন্তু কোনদিন ওকালতি পেশা গ্রহণ করেননি।

ছোট বয়েসেই রনো বাংলা ও বিদেশী ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। কিশোর বয়সেই বাবার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, সেক্সপিয়ারের বিভিন্ন কাব্য শুনে শুনে মুখস্থ তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। চমৎকার আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বির্তক ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বহু পুরস্কার লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ভালো বক্তা হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাকে বলা হতো অনলবর্ষী বক্তা।

ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যার ছাত্র থাকা কালে ১৯৬০ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশিস্নষ্ট হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানিন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচত হন। ১৯৬১ সালে তিনি মেধাবী ছাত্র হিসাবে যে সিয়াটো স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তারপুরোটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে চাঁদা হিসাবে দিয়েছিলেন।

তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না। কোন ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্বও ছিল না। এই সময়ে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাত্র গোপনে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তার মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও হায়দার আকবর খান রনো। টার্গেট ছিল ২১ ফেব্রুয়ারীর মিছিল থেকে শুরু হবে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। ইতোমধ্যে ৩০ জানুয়ারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে টার্গেটের তারিখ এগিয়ে আনা হয়। ঠিক হয় ১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হবে। রনোসহ অন্যান্যরা এই ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্র সভা হয়েছিল, সেখানে একজনই বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন।

৬২ সাল জুড়ে যে ঐতিহাসিক সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন হয় রনো তার নেতৃত্বে ছিলেন। তখনো পর্যন্ত কোন সংগঠিত ছাত্র সংগঠন ছিল না। ছাত্র নেতারা ঠিক করলেন ১৯৫২ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে (যা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো) পুনর্জীবিত করা হোক। বস্তুতঃ পুরাতন নাম গ্রহণ করলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে নতুন করে গঠন করা হয়েছিল।

অক্টোবর মাসে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনের পুনর্জন্ম হয়েছিল। ঐ সম্মেলনে হায়দার আকবর খান রনো ৬২-এর আন্দোলনের উপর রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করেন। ডাঃ আহমদ জামান’কে সভাপতি, কাজী জাফর আহমদ’কে সাধারণ সম্পাদক ও হায়দার আকবর খান রনো’কে যুগ্ম সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ৬২ সালে রনো দুইবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ৬২-এর মার্চ মাসে তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছিল। পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। যেখানে ছাব্বিশ সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তিনি একত্রে ছিলেন।

পরের বছর ১৯৬৩ সালে হায়দার আকবর খান রনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে ও দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়, যা তখনকার সকল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। তিনি আত্মগোপনে গেলেন। কিন্তু দুই মাস পর ধরা পড়েন। তাঁকে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে দুই দিন ও দুই রাত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়েছিল। ঘুমাতে দেয়া হয়নি তাঁকে। মাথার উপর রাখা হয়েছিল অনেক পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি।

১৯৬৫ সালের তাঁর জেলে থাকাকালেই ছাত্র ইউনিয়নের একাংশকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৬৫ সালে তিনি রেল ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আবার স্বল্পকালের জন্য কারারুদ্ধ হন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মুক্তির পর তিনি আর ছাত্র সংগঠন করবেন না এবং সরাসরি শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

শ্রমিক আন্দোলন:

১৯৬৬ সালে কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকবর খান রনো টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক আন্দেলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এই দুইজন একত্রে টঙ্গী অঞ্চলে যে শ্রমিক আন্দেলন গড়ে তুলেছিলেন তা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

হায়দার আকবর খান রনো ঢাকার বাসা ছেড়ে টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে বাস করতে শুরু করেন। সাপ্তাহে এক আধবার ঢাকায় আসতেন রাজনৈতিক কারণে। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব বাড়ী-ঘর ছেড়ে শ্রমিক বস্তিতে দিনের পর দিন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ঘটনা আমাদের দেশে খুব বেশী নেই। রণোর এই জীবন বিপ্লবীদের জন্য এক দৃষ্টান্ত।

গ্রেফতারী পরওয়ানা এড়িয়ে তিনি শ্রমিক কলোনী বা বস্তিতে বাস করতেন। টঙ্গীতে যে ধরণের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর যে ধরণের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে টঙ্গী অঞ্চল থেকে পুলিশের পক্ষে খুব বড় রকমের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁকে গ্রেফতার করা সহজ ছিল না। এরপর তিনি আর কখনো গ্রেফতার হননি। তবে আত্মগোপনে গেছেন অনেকবার।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল। একদিকে টঙ্গীতে শ্রমিক আন্দোলন, পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে টঙ্গী থেকেই শুরু হলো ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। পরে ঘেরাও আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। রনোকে তখন টঙ্গীর বাইরে অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলেও যেতে হয়েছে সংগঠন গড়ে তুলতে ও নেতৃত্ব দিতে। বলা যেতে পারে তাঁর নেতৃত্বে এক নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

১৯৬৯-৭০ সালে দ্বিতীয় সামরিক শাসন আমলে টেক্সটাইল শ্রমিকদের যে ঐতিহাসিক দুইমাস ব্যাপী বেআইনী ধর্মঘট হয়েছিল রনো ছিলেন তার নেতৃত্বে। টঙ্গী অঞ্চলে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সাহসী নেতা হায়দার আকবর খান রনো। সেসব ঘটনা এখনো কিংবাদন্তির মতো রয়েছে। ১৯৭০ সালে তিনি তদানিন্তন সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন:

ছেলে বেলায় পারিবারিক সূত্রে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসেন। কিছু কিছু মার্কসবাদী গ্রন্থ তিনি স্কুলজীবনে কলকাতা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের আগে এদেশে মার্কসবাদী সাহিত্য নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬০ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক মতবিতর্কের ফলে বিভক্ত হলে তিনি তথাকথিত চীনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী দুই বছরে ঐ অংশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি।

১৯৭১ সালে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরী হয়েছিল। এই সকল অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি শিবপুর যান যেখান থেকে পরবর্তীতে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র ঘাঁটি অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। শিবপুরের সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিশাল মুক্তিবাহিনী এবং ঘাঁটি অঞ্চল। সেখান থেকে তিনি এবং রাশেদ খান মেনন নানা পথ ঘুরে টাঙ্গাইলের বিন্নাফুর গ্রামে গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। পরদিনই মাওলানা ভাসানীর বাসা পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রানত্ম হয়েছিল। একদিন পরেই ভাসানীর সঙ্গে রণো মেনন বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক চেষ্টা করেও তারা আর যোগযোগ করতে পারেননি।

১৯৭১ এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পর্টির সহায়তায় বামপন্থীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। হায়দার আকবর খান রনো এই কমিটির ঘোষাণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন।

ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। পরবর্তীজীবনে তিনি মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালেই রনোর পরিচয় ঘটে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদসহ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতার সাথে। কমরেড রণোর সঙ্গে অনেক বিদেশী কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কাস পার্টির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কমিউনিস্ট পার্টিসমুহের অনেক আন্তর্জাতি সম্মেলনেও তিনি যোগাদান করেছেন।

১৯৭৩ সালে কমরেড রনো ও অন্যান্য সহকর্মীরা মিলে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে পার্টির নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি। প্রথম থেকেই তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে রাশেদ খান মেননের সাথে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিরোধ তৈরি হলে তিনি ওয়ার্কাস পার্টির একাংশ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন। বর্তমানে ঐ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি কমিউনিস্ট ঐক্যের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাওলানা ভাসনীর ঘানিষ্ঠ অনুসারী হলেও এবং বিভিন্ন সময় ন্যাপের কর্মকন্ডে ভূমিকা রাখলেও তিনি কখনও ন্যাপের সভ্য হননি। ১৯৭৪ সালে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তাঁর সহ-সভপতি ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। সুদীর্ঘ রাজনৈতিকজীবনে জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি বুর্জোয়া সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব সাংগঠনিক আন্দোলনগত কাজের মধ্য দিয়ে। রণোর মধ্যে বাস্তব সংগ্রাম ও তত্ত্বেও সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সাহস, দৃঢ়তা, কৌশলগত নমনীয়তা ও বুদ্ধিমত্তার এক অর্পূব সমন্বয় দেখা যায়।

এরশাদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রথম থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। সাতবার তাঁর নামে হুলিয়া জারী হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। এরশাদ আমলের নয় বছরে তাঁর বাসায় পঞ্চাশ বারের বেশী মিলিটারী পুলিশ রেইড করেছিল। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার।

লেখালেখি:

রনো একদিকে জননেতা, অপরদিকে তাত্ত্বিক ও লেখক। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন এমনকি সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপরও তাঁর অজস্র লেখা আছে।

তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২৪ বৎসর বয়সে “সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা”। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্য ২৫টি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইয়ের তালিকা নিচে দেওয়া হল।

  • শতাব্দী পেরিয়ে
  • ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব
  • পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা
  • কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন
  • রবনীন্দ্রনাথ- শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে
  • মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ
  • বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
  • পলাসী থেকে মুক্তিযুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
  • নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রথম খণ্ড)
  • মার্কসবাদের প্রথম পাঠ
  • মার্কসীয় অর্থনীীত
  • মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম
  • গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাধো
  • আজকের সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়

অন্যান্য:

হায়দার আকবর খান রনো খুব সরল জীবনযাপন করেন। নিরহঙ্কার মানুষটি সহজ সরলভাবে মিশতে পারেন যে কোন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে এবং সকলেই তাঁর আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে যে গরীব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি কাজ করেন, তারা তাঁকে আপন বলে গ্রহণ করতে পারে রনোর নিজস্ব চারিত্রিক ও আচরণগত বৈশিষ্টের কারণে।

একমাত্র রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন পেশাও তার ছিল না। তিনি ছিলেন সার্বক্ষনিক রাজনীতিবিদ। তবে খবরের কাগজে কলম লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের থেকে তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করেছেন।

আগ্রহের বিষয়:

তিনি সাহিত্য পড়তে ভালবাসেন। বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের বহু কবিতা তাঁর এখনও মুখস্থ আছে। সুযোগ পেলেই তিনি ভালো সিনেমা ও নাটক দেখেন। ক্রিকেট খেলায় তাঁর আগ্রহ আছে।

পরিবারিক পরিচিতি:

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা হায়দার আকবর খান রণো ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলকাতায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইল জেলায় এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান রণো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর ডাক নাম রাখা হয়েছিল রণো। এখন তিনি এই নামেই পরিচিত। পিতৃভূমি নড়াইল জেলার নড়াইল থানার অন্তর্গত চিত্রা নদীর পাড়ে বরশালা গ্রাম (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অন্তর্গত)। নানাবাড়ি নড়াইল থানায় অন্তর্গত মির্জাপুর গ্রাম। নানা ছিলেন ছিলেন উপ-মহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিক সৈয়দ নওশের আলী।

পিতা হাতেম আলী খান ছিলেন একজন প্রকৌশলী। ১৯৬৮ সালে মরহুম হাতেম আলী খান তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে অবসরগ্রহণ করেন। সৎ ও যোগ্য অফিসার হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৯৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রণোর মা কানিজ ফতেমা মোহসিনা ছিলেন সৈয়দ নওশের আলীর দ্বিতীয় কন্যা। বাম রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি রণোর মা’র অকৃত্রিম ভালবাসা ও সহযোগিতার জন্য বাম প্রগতিশীল মহলের তিনি বিশেষ পরিচিত ও শ্রদ্ধার স্থানে অবস্থান করেছিলেন। রণোর মানসিক গড়নের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। রণোর ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনোও একজন বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

হায়দার আকবর খান রণো’র একমাত্র কন্যা রানা সুলতানা। তার দুই নাতি আছে। অরিত্র ও অন্তিক।

শিক্ষাজীবন:

হায়দার আকবর খান রণো ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলজীবনে তিনি বরাবরই ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করতেন। যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্টগ্রেগরী স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকাস্থ সেন্টগ্রেগরী স্কুল হতে ম্যট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তিনি মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটরডেম কলেজ হতে আই এস সি পাশ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু পদার্থবিদ্যার কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি কারাবাস ও অন্যান্য কারণে। পরে তিনি কারাগারে অবস্থানকালে আইনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন। কিন্তু কোনদিন ওকালতি পেশা গ্রহণ করেননি।

ছোট বয়েসেই রণো বাংলা ও বিদেশী ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। কিশোর বয়সেই বাবার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, সেক্সপিয়ারের বিভিন্ন কাব্য শুনে শুনে মুখস্থ তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। চমৎকার আবৃত্তির পাশাপাশি তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বির্তক ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বহু পুরস্কার লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ভালো বক্তা হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ছাত্রজীবনে তাকে বলা হতো অনলবর্ষী বক্তা।

ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যার ছাত্র থাকা কালে ১৯৬০ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশিস্নষ্ট হন। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৬৩ সাল হতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানিন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচত হন। ১৯৬১ সালে তিনি মেধাবী ছাত্র হিসাবে যে সিয়াটো স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে চাঁদা হিসাবে দিয়েছিলেন।

তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না। কোন ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্বও ছিল না। এই সময়ে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাত্র গোপনে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তার মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও হায়দার আকবর খান রণো। টার্গেট ছিল ২১ ফেব্রুয়ারীর মিছিল থেকে শুরু হবে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। ইতোমধ্যে ৩০ জানুয়ারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে টার্গেটের তারিখ এগিয়ে আনা হয়। ঠিক হয় ১ ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হবে। রণোসহ অন্যান্যরা এই ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। ১ ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্র সভা হয়েছিল, সেখানে একজনই বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রণো। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন।

৬২ সাল জুড়ে যে ঐতিহাসিক সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন হয় রণো তার নেতৃত্বে ছিলেন। তখনো পর্যন্ত কোন সংগঠিত ছাত্র সংগঠন ছিল না। ছাত্র নেতারা ঠিক করলেন ১৯৫২ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে (যা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো) পুনর্জীবিত করা হোক। বস্তুতঃ পুরাতন নাম গ্রহণ করলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে নতুন করে গঠন করা হয়েছিল।

অক্টোবর মাসে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনের পুনর্জন্ম হয়েছিল। ঐ সম্মেলনে হায়দার আকবর খান রণো ৬২-এর আন্দোলনের উপর রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করেন। ডাঃ আহমদ জামান’কে সভাপতি, কাজী জাফর আহমদ’কে সাধারণ সম্পাদক ও হায়দার আকবর খান রণো’কে যুগ্ম সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ৬২ সালে রণো দুইবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ৬২-এর মার্চ মাসে তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছিল। পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। যেখানে ছাব্বিশ সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তিনি একত্রে ছিলেন।

পরের বছর ১৯৬৩ সালে হায়দার আকবর খান রণো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে ও দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তাঁর নামে হুলিয়া বের হয়, যা তখনকার সকল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। তিনি আত্মগোপনে গেলেন। কিন্তু দুই মাস পর ধরা পড়েন। তাঁকে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে দুই দিন ও দুই রাত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়েছিল। ঘুমাতে দেয়া হয়নি তাঁকে। মাথার উপর রাখা হয়েছিল অনেক পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি।

১৯৬৫ সালের তাঁর জেলে থাকাকালেই ছাত্র ইউনিয়নের একাংশকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইতোমধ্যে ১৯৬৫ সালে তিনি রেল ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আবার স্বল্পকালের জন্য কারারুদ্ধ হন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মুক্তির পর তিনি আর ছাত্র সংগঠন করবেন না এবং সরাসরি শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।

শ্রমিক আন্দোলন:

১৯৬৬ সালে কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকবর খান রণো টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক আন্দেলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এই দুইজন একত্রে টঙ্গী অঞ্চলে যে শ্রমিক আন্দেলন গড়ে তুলেছিলেন তা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

হায়দার আকবর খান রণো ঢাকার বাসা ছেড়ে টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে বাস করতে শুরু করেন। সাপ্তাহে এক আধবার ঢাকায় আসতেন রাজনৈতিক কারণে। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব বাড়ী-ঘর ছেড়ে শ্রমিক বস্তিতে দিনের পর দিন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ঘটনা আমাদের দেশে খুব বেশী নেই। রণোর এই জীবন বিপ্লবীদের জন্য এক দৃষ্টান্ত।

গ্রেফতারী পরওয়ানা এড়িয়ে তিনি শ্রমিক কলোনী বা বস্তিতে বাস করতেন। টঙ্গীতে যে ধরণের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে এবং শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর যে ধরণের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে টঙ্গী অঞ্চল থেকে পুলিশের পক্ষে খুব বড় রকমের প্রস্তুতি ও ঝুঁকি নেয়া ছাড়া তাঁকে গ্রেফতার করা সহজ ছিল না। এরপর তিনি আর কখনো গ্রেফতার হননি। তবে আত্মগোপনে গেছেন অনেকবার।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও তাঁর ভূমিকা ছিল। একদিকে টঙ্গীতে শ্রমিক আন্দোলন, পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে টঙ্গী থেকেই শুরু হলো ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। পরে ঘেরাও আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। রণোকে তখন টঙ্গীর বাইরে অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলেও যেতে হয়েছে সংগঠন গড়ে তুলতে ও নেতৃত্ব দিতে। বলা যেতে পারে তাঁর নেতৃত্বে এক নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

১৯৬৯-৭০ সালে দ্বিতীয় সামরিক শাসন আমলে টেক্সটাইল শ্রমিকদের যে ঐতিহাসিক দুইমাস ব্যাপী বেআইনী ধর্মঘট হয়েছিল রণো ছিলেন তার নেতৃত্বে। টঙ্গী অঞ্চলে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সাহসী নেতা হায়দার আকবর খান রণো। সেসব ঘটনা এখনো কিংবাদন্তির মতো রয়েছে। ১৯৭০ সালে তিনি তদানিন্তন সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন:

ছেলে বেলায় পারিবারিক সূত্রে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসেন। কিছু কিছু মার্কসবাদী গ্রন্থ তিনি স্কুলজীবনে কলকাতা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের আগে এদেশে মার্কসবাদী সাহিত্য নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬০ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক মতবিতর্কের ফলে বিভক্ত হলে তিনি তথাকথিত চীনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী দুই বছরে ঐ অংশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে গঠন করেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি।

১৯৭১ সালে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি তৈরী হয়েছিল। এই সকল অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক পরিচালনা এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি শিবপুর যান যেখান থেকে পরবর্তীতে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র ঘাঁটি অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। শিবপুরের সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল বিশাল মুক্তিবাহিনী এবং ঘাঁটি অঞ্চল। সেখান থেকে তিনি এবং রাশেদ খান মেনন নানা পথ ঘুরে টাঙ্গাইলের বিন্নাফুর গ্রামে গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। পরদিনই মাওলানা ভাসানীর বাসা পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রানত্ম হয়েছিল। একদিন পরেই ভাসানীর সঙ্গে রণো মেনন বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক চেষ্টা করেও তারা আর যোগযোগ করতে পারেননি।

১৯৭১ এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পর্টির সহায়তায় বামপন্থীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। হায়দার আকবর খান রণো এই কমিটির ঘোষাণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন।

ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। পরবর্তীজীবনে তিনি মাওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালেই রণোর পরিচয় ঘটে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদসহ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতার সাথে। কমরেড রণোর সঙ্গে অনেক বিদেশী কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কাস পার্টির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কমিউনিস্ট পার্টিসমুহের অনেক আন্তর্জাতি সম্মেলনেও তিনি যোগাদান করেছেন।

১৯৭৩ সালে কমরেড রণো ও অন্যান্য সহকর্মীরা মিলে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে পার্টির নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কাস পার্টি। প্রথম থেকেই তিনি পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০৯ সালে রাশেদ খান মেননের সাথে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিরোধ তৈরি হলে তিনি ওয়ার্কাস পার্টির একাংশ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হন। বর্তমানে ঐ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি কমিউনিস্ট ঐক্যের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

মাওলানা ভাসনীর ঘানিষ্ঠ অনুসারী হলেও এবং বিভিন্ন সময় ন্যাপের কর্মকন্ডে ভূমিকা রাখলেও তিনি কখনও ন্যাপের সভ্য হননি। ১৯৭৪ সালে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তাঁর সহ-সভপতি ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। সুদীর্ঘ রাজনৈতিকজীবনে জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি বুর্জোয়া সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব সাংগঠনিক আন্দোলনগত কাজের মধ্য দিয়ে। রণোর মধ্যে বাস্তব সংগ্রাম ও তত্ত্বেও সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সাহস, দৃঢ়তা, কৌশলগত নমনীয়তা ও বুদ্ধিমত্তার এক অর্পূব সমন্বয় দেখা যায়।

এরশাদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রথম থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছেন। সাতবার তাঁর নামে হুলিয়া জারী হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। এরশাদ আমলের নয় বছরে তাঁর বাসায় পঞ্চাশ বারের বেশী মিলিটারী পুলিশ রেইড করেছিল। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার।

লেখালেখি:

রণো একদিকে জননেতা, অপরদিকে তাত্ত্বিক ও লেখক। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের উপরও তাঁর অজস্র লেখা আছে।

তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২৪ বৎসর বয়সে “সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা”। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্য ২৫টি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইয়ের তালিকা নিচে দেওয়া হল।

  • শতাব্দী পেরিয়ে
  • ফরাসী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব
  • পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা
  • সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর
  • কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন
  • রবীন্দ্রনাথ- শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে
  • মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ
  • বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
  • পলাসী থেকে মুক্তিযুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)
  • নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রথম খণ্ড)
  • মার্কসবাদের প্রথম পাঠ
  • মার্কসীয় অর্থনীীত
  • মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম
  • গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাধো
  • উত্তাল ষাটের দশক

অন্যান্য:

হায়দার আকবর খান রনো খুব সরল জীবনযাপন করেন। নিরহঙ্কার মানুষটি সহজ সরলভাবে মিশতে পারেন যে কোন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে এবং সকলেই তাঁর আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে যে গরীব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি কাজ করেন, তারা তাঁকে আপন বলে গ্রহণ করতে পারে রনোর নিজস্ব চারিত্রিক ও আচরণগত বৈশিষ্টের কারণে।

একমাত্র রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন পেশাও তার ছিল না। তিনি ছিলেন সার্বক্ষনিক রাজনীতিবিদ। তবে খবরের কাগজে কলম লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের থেকে তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করেছেন।

আগ্রহের বিষয়:

তিনি সাহিত্য পড়তে ভালবাসেন। বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের বহু কবিতা তাঁর এখনও মুখস্থ আছে। সুযোগ পেলেই তিনি ভালো সিনেমা ও নাটক দেখেন। ক্রিকেট খেলায় তাঁর আগ্রহ আছে।